আজ ৯ জুলাই। ১৯৭৯ সালের এই দিনে তৎকালীন সংসদে সংবিধানের গৃহীত পঞ্চম সংশোধনীতে নতুন সংশোধনী আনা হয়। এটি ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর ক্ষমতা দখলকারী গোষ্ঠীর দৃশ্যমান নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি পদ দখল করে ওই বছর ২৬ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার রাষ্ট্রীয়ভাবে বন্ধ রাখার জন্য যে অধ্যাদেশ জারি করেন সেটি সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে ‘নতুন সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত’ হিসেবে এইদিনে গৃহীত হয়।
অথচ পঞ্চম সংশোধনীটি সামরিক শাসনের শুরু থেকে নতুন দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ (২ এপ্রিল, ১৯৭৯-২০ মার্চ, ১৯৮২) শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত জারি করা অধ্যাদেশসমূহের সম্মিলিত সংশোধনী যা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী হিসেবে পরিচিত হয়েছে।
সেটি সেই সময়ের সরকার কর্তৃক উত্থাপিত সংবিধান সংশোধনী বিল যা প্রস্তুত হয়েছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ এবং সংসদে আইন হিসেবে ৬ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান উত্থাপিত এবং ৯ এপ্রিলে সংসদে পঞ্চম সংশোধনী আইন নামে পাস হয়। পঞ্চম সংশোধনী পাস করার পর ৯ জুলাই সংবিধানের একই সংশোধনীতে সংযোজিত সংশোধনী হিসেবে ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ সালে জারি করা রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ ৫০ তথা Idemnity Act (দায়মুক্তি অধ্যাদেশ) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে এটি সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীরই অংশ হয়। পুর্ণাঙ্গ এই পঞ্চম সংশোধনীটি বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী হিসেবে পরিচিতি পায়।
দুই অংশের এই অধ্যাদেশের প্রথম অংশে লেখা হয়, “১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থি যাই কিছু ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাইবে না।”
দ্বিতীয় অংশে বলা হয়,“রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যায়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হইলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাইবে না।”
১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা যেমন ছিল একটি রাষ্ট্রীয় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, একইভাবে সংবিধান অনুযায়ী উপরাষ্ট্রপতির হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত না হয়ে খন্দকার মোশতাক কর্তৃক রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হওয়া ছিল সংবিধান এবং আইনবিরোধী।
খন্দকার মোশতাক আহমদের রাষ্ট্রপ্রতি পদে জারিকৃত সকল আদেশ, অধ্যাদেশ ও সিদ্ধান্তই ছিল সংবিধান ও রাষ্ট্রের আইনবহির্ভূত। দেশের সংসদ (৭ এপ্রিল, ১৯৭৩-৬ নভেম্বর, ১৯৭৫) কার্যকর থাকা সত্ত্বেও সংসদের অধিবেশন না ডেকে রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অর্পণ, সরকার গঠন ও সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার সংবিধান অনুযায়ী কারো নেই।
সুতরাং খন্দকার মোশতাক সংবিধান বহির্ভূতভাবে রাষ্ট্রপতির পদ দখল, মন্ত্রিপরিষদ গঠন ও আইন, অধ্যাদেশ ও বিধিবিধান জারি করাই বেআইনি। সেই বেআইনি রাষ্ট্রপতির জারি করা অধ্যাদেশ ৫০ কোনো অবস্থাতেই রাষ্ট্রের আইন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। এছাড়া অধ্যাদেশে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচার না করা সম্পর্কে যে আদেশ জারি করা হয়েছে সেটিও সম্পূর্ণরূপে এখতিয়ার বহির্ভূত অপরাধমূলক কাজ। সেই অধ্যাদেশটি এমনিতেই বিলুপ্ত হওয়ার বিষয় ছিল।
ক্ষমতাদখলকারী সরকার ৬ নভেম্বর (১৯৭৫) সংসদ ভেঙে দেয়ার পর খন্দকার মোশতাকের জারি করা অধ্যাদেশ ৫০ আপনা থেকেই অকার্যকর ও বিলুপ্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ৭ নভেম্বরে ক্ষমতাদখলকারী সামরিক সরকার অধ্যাদেশ ৫০কে ধারণ ও বহন করেই সম্পূর্ণরূপে বেআইনিভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করার অধ্যাদেশটি রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জারি রাখে। সেটি ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ‘নির্বাচন’ এবং গঠিত দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ ও সরকার কর্তৃক সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী আইনে প্রথমে অন্তর্ভুক্ত না করে সংশোধনী হিসেবে পরে পঞ্চম সংশোধনীর অংশ হিসেবে সংযোজন করা হয়। এই অধ্যাদেশটি এর মাধ্যমে যেভাবে বাংলাদেশের সংবিধানে পুনরুজ্জীবিত করা হয়, তা রাষ্ট্রবিরোধীভাবে সংগঠিত হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ করে রাখা, অবৈধ কর্মকাণ্ডকে পবিত্র সংবিধানে যুক্ত করাটি নতুন অপরাধ হিসেবেই বিবেচিত হওয়ার কথা।
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর সংযোজিত অধ্যাদেশ ৫০ যারা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং হত্যাকাণ্ডের বিচার রুদ্ধ করা, হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দেয়া, মামলা করার সুযোগ বন্ধ করে দেয়া সংবিধানকে যেমনিভাবে কলঙ্কিত করে, একইভাবে রাষ্ট্র ও রাজনীতির অংশ হিসেবে তারা এর দায় বহন করেন। তাদের অবস্থানও সম্পূর্ণরূপে এই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকা সকল অপরাধীর অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচার চায় না, এমন একটি ধারণা হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হওয়ার পর দেশ ও বিদেশে অনুমিত হতে থাকে, অধ্যাদেশটি জারির মধ্য দিয়ে সেই অপরাধকে সমর্থন করা এবং বিচার বন্ধ করে রাখার যে জোরপূর্বক তথা এখতিয়ার বহির্ভূত বিধান জারি রেখে সেটিকে ৪ বছর পর সংবিধানে জাতীয় সংসদকে ব্যবহার করে বৈধতা দেয়ার বিষয়টি দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের চরিত্রকে কলঙ্কিত ও বিতর্কিত করা হয়। সেই সাংবিধানিক তথাকথিত অধ্যাদেশ বলে বাংলাদেশের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড নিয়ে মামলা রুজুর অধিকার হরণ করা হয়, হত্যাকারীদের রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনীতিতে অবাধে বিচরণ, অপকর্ম করার লাইসেন্স প্রদান করা হয়। এর মাধ্যমে ১৯৭৫-এর হত্যাকাণ্ড ও এর সঙ্গে যুক্ত অপরাধীরাই শুধু নয় ক্ষমতায় থাকা, রাজনীতি করা এবং এই অধ্যাদেশকে বহাল রেখে রাষ্ট্রকে ক্রমেই ‘অপরাধীদের দায়মুক্ত রাষ্ট্রে’ শক্তিশালী হওয়ার ব্যবস্থা চিরস্থায়ী করা হয়। এর নেতিবাচক প্রভাব রাষ্ট্র ও সমাজের সব ক্ষেত্রে পড়া ও বিস্তার করার সুযোগ অবারিত রাখা হয়।
এটি কোনো আধুনিক রাষ্ট্রের সংবিধানের অংশ হতে পারে না। একইসঙ্গে রাষ্ট্রকে মানবিক, গণতান্ত্রিক, আধুনিক রূপদানের সুযোগও রাখে না, বরং রুদ্ধ করে রাখে। বাংলাদেশে এমন একটি মানবতাবিরোধী অপরাধকে আমরা দীর্ঘদিন বহন করতে দেখেছি। যদিও ১৫ আগস্টের পর থেকেই এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি ধীরে ধীরে সমাজের ভেতর থেকেই উত্থাপিত হতে থাকে, আন্তর্জাতিকভাবেও উন্নত দেশগুলোর মানবতাবাদী শক্তিসমূহ এই দাবির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন অনেকগুলো সরকার দায়মুক্তির এই অধ্যাদেশ বাতিলের দাবির প্রতি কর্ণপাত করতে চায়নি, বরং উপেক্ষা করেছিল এবং দাবি উত্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারী এবং তাদের সমর্থনপুষ্ট নানা গুন্ডাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছিল আন্দোলনকারীদের দমন করার জন্য।
সরকারগুলো এই অপরাধীদের মদদ দিয়েছিল। একই সঙ্গে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পক্ষে নানা ধরনের মিথ্যা অপপ্রচার, বিকৃত রাজনৈতিক ইতিহাস, রাজনীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসন ও সমাজ ব্যবস্থায় বিস্তারের নানা ধরনের আয়োজন অব্যাহত রেখেছিল। ফলে গোটা রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থাই এমন একটি দায়মুক্ত অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকা, সেটিকে টিকিয়ে রাখার সকল প্রকার ব্যবস্থা, প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগেও দ্বিধা করেনি। কিন্তু ১৯৭৫ -এর হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে শুধু আওয়ামী লীগই নয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্যান্য রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, যুব ও ছাত্র সংগঠন অব্যাহত রাখার জন্য নিরলসভাবে সংগ্রাম করে আসছিল। সেই সংগ্রামেরই শক্তি ক্রমেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিস্তৃত এবং শক্তিশালী হতে থাকে।
নানা অপপ্রচার, বিভ্রান্তি, বিকৃতি এবং অপশক্তিসমূহের অপকর্মের বিষয়গুলো ক্রমেই বৃহত্তর জনগণের কাছে স্পষ্ট হতে থাকে, বাংলাদেশ যুদ্ধপরাধের পাশাপাশি যে আরেকটি ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধকে ১৫ আগস্টের পর থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বহন করে চলে আসছে যা কোনো অবস্থাতেই আর চলতে দেয়া যায় না এমন বোধ ও সচেতনতা আমাদের বৃহত্তর সমাজে ক্রমেই উদ্ভাসিত হতে থাকে। সমাজের ভেতর থেকে তৈরি হওয়া এই সচেতনতাই Indemnity Act বাতিলের দাবিকে রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে এবং সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্র তৈরি করে।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সমর্থনে আওয়ামী লীগপ্রধান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকার গঠনের সুযোগ লাভ করেন। ওই বছর ২৩ জুন তারিখে তিনি সরকার গঠন করেন। সরকার গঠনের পর নতুন এই সরকারের কাঁধে ৭৫ পরবর্তী সৃষ্ট মুক্তিযুদ্ধ ও মানবতাবিরোধী যেসব অপরাধকে সরকারগুলো ধারণ ও লালন করে এসেছিল, বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে সেসব অপরাধ বহন করার অমর্যাদাকর ধারা থেকে মুক্ত করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের তাগিদ বাস্তবায়নে হাত দিতে হয়। এর পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি-রাজনীতি, বিদেশনীতি ইত্যাদিতেও মৌলিক আদর্শগত বিচ্যুতি থেকে দেশকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হয়।
শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অমর্যাদাকর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর দায়মুক্তির অধ্যাদেশ সংযোজনের আইনটি বাতিলের আইনগত উদ্যোগ নেয়। সপ্তম জাতীয় সংসদে ১২ নভেম্বর তারিখে Indemnity Act বাতিল করা হয়। ওইদিন বিএনপি ও জামায়াত হরতাল আহ্বান করে। বিএনপি ও জামায়াতের সদস্যরা সংসদে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। ১৯৭৫-এর খুনিদেরই শুধু নয়, নিজেদের এতদিনকার অবস্থানকেও টিকিয়ে রাখতে তাদের এই অবস্থান গ্রহণ। বলা চলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের অংশীজন এবং সুবিধাভোগী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের ধরে রাখাই শুধু নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ৭৫ পরবর্তী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির শক্তি হিসেবে তাদের সাংবিধানিক অবস্থা তারা জারি রেখেছে। এটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য একটি বিপজ্জনক সংকেত বলে চিহ্নিত হয়েছে।
মুখে যদিও বিএনপি জামায়াত ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্রব নেই বলে দাবি করে থাকে। এটিকে নিছক আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের প্রতিক্রিয়া হিসেবে দাবি করে থাকে। কিন্তু ৭৫ পরবর্তী সময়ে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান, পঞ্চম সংশোধনীতে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ সংযোজন, হত্যাকারীদের সকল প্রকার সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের যে নজির ও অভিযোগ ছিল, সেটিকে তারা ১২ নভেম্বরে হরতাল ডাকা, বিল পাসে অনুপস্থিত থাকার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের অবস্থান স্পষ্ট, দৃশ্যমান এবং দালিলিকভাবে প্রমাণিত করে রেখেছিল।
এতে কোনো প্রকার রাখ-ঢাক রাখা হয়নি। ১৯৭৫-এর পরে যেভাবে বাংলাদেশে এবং বিদেশে ৭৫-এর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি এবং রাষ্ট্র রাজনীতির আদর্শিক ধারার একটি শক্তির উত্থান ঘটার দৃশ্য পরিস্ফুট হয়েছে। ঠিক এর বিপরীতে সংবিধান, মানবতা, আইন, গণতন্ত্র ও নৈতিকতার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান শক্তি হিসেবে বিএনপি ও জামায়াত নিজেদেরকে নিজেরাই চিহ্নিত করে দিয়েছে।
কোনো বোধসম্পন্ন যুক্তিবাদী আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় এ ধরনের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়িত শক্তির পক্ষে অবস্থান নেয়ার সাহস, নৈতিক অবস্থানকেও দেখানোর কথা ভাবতে পারা যায় না। ভোটারদের মধ্যেও এ ধরনের অবস্থান নিয়ে নিজেদের চিন্তাভাবনা, রাজনৈতিক সচেতনতা, বিশ্বাসবোধ ইত্যাদি নতুন উপলব্ধিতে গড়ে ওঠার লক্ষণ দেখা দেয়। মানবতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে এভাবেই আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় গড়ে উঠতে দেখা যায়। ত্যাগ করা হয় মিথ্যাচার-অন্যায়, অবিচার-মানবতা, যুক্তি ও বিচারবিরোধী অবস্থানের। অর্থাৎ একটি অপশক্তির অভ্যন্তরে মহৎ শক্তির অবস্থান জন্ম নিতে থাকে, ভেঙে যায় অপশক্তি।
আমাদের দেশে গণতন্ত্র-মানবতাবাদ, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-সংবিধান, মূল্যবোধ, ন্যায়ভিত্তিক সমাজপ্রতিষ্ঠার শক্তি এবং সমাজের অভ্যন্তরে যুক্তিবাদের দুর্বলতা, ঘাটতি-অপুষ্টতা ইত্যাদি বিষয়গুলো কোথায় লুকিয়ে রয়েছে, হতাশার জায়গা তৈরি করছে সেটি এখানেই দৃশ্যমান হচ্ছে। সেখান থেকে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে রাজনীতি ও মতাদর্শগত অবস্থান তৈরি করার জনসচেতনতা ও প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা ছাড়া বাংলাদেশে অন্য কোনো উপায়ে প্রত্যাশিত গণতন্ত্র ও আধুনিক ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়- সেটিও বিবেকসম্পন্ন যেকোনো মানুষের বোঝার কথা। আমরা কতটা বুঝতে পারছি সেটিই মৌলিক প্রশ্ন।
১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বাতিল হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার মামলা শুরু করার সাংবিধানিক বাধা অপসারিত হয়। মামলাটি তখনই কেবল পরিপূর্ণভাবে শুরু করা হয়। নিম্ন আদালতেই মামলাটির কার্যক্রম চলে। রাষ্ট্র ও সরকারের কোনো আইনবহির্ভূত অভিপ্রায় কার্যকর করার সামান্যতম সুযোগ রাখা হয়নি। মামলায় যেসব আসামির নাম অন্তর্ভুক্ত হয় তাদের আইনগত সকল সুযোগ দেয়া হয়। তাদের অনেকেই সেটি গ্রহণ করে।
আদালতের বিচারের রায়ে বেশ কয়েকজন খুনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়। তবে কেউ কেউ শুরু থেকেই পলাতক ছিল। মামলাটি নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালতে যথা নিয়মে বিচার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়। এই দীর্ঘ সময়ে আসামি এবং তাদের সমর্থকগণ অনেকেই নানা ধরনের হুমকি-ধামকি, মিছিল-সমাবেশ করেছে। বিএনপি জামায়াত বিচার ও বিচারের রায় নিয়ে হরতাল পালন, মিছিল-সমাবেশ এবং নানা ধরনের বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করেছে। উচ্চ আদালতে কয়েকজন বিচারপতি মামলার শুনানিতে ‘বিব্রত’বোধ করায় মামলাটি কালক্ষেপণে পড়ে। এর মাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় এমনকি বিচারপতিদের কারো কারো অবস্থানের দিকেও ধারাটি ধরা পড়ে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি জামায়াত জোট সরকার গঠিত হয়। উচ্চ আদালতে মামলার ভাগ্য হিমাগারে নির্ধারিত হয়।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর মামলাটি হিমাগার থেকে আবার মুক্তি পেয়ে উচ্চ আদালতে যাওয়ার পরিবেশ পায়। উচ্চ আদালত মামলাটি আইনানুগভাবে সম্পন্ন করে চূড়ান্ত রায় প্রদান করেন। তাতে আসামিদের অনেকেই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়। সেটি কার্যকরও হয়। কিন্তু কয়েকজন বিদেশে পলাতক থাকায় রায়টি পুর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর করা যায়নি। তবে ১৯৭৫-এর হত্যাকাণ্ডের বিচার রুদ্ধ করার ষড়যন্ত্র, গ্লানি এবং মানবতাবিরোধী অবস্থান থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হওয়ার যে আন্দোলন, সংগ্রাম দীর্ঘদিন করে এসেছিল সেটি অবশেষে নানা বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে রাষ্ট্রের আইন ও সাংবিধানিক ধারায় বিচার সম্পন্ন করার একটি বৈধ নজির স্থাপিত হয়। বাংলাদেশ কলঙ্কমুক্ত হয়।
বাংলাদেশেরই একটি গোষ্ঠী সেই কলঙ্ককে ধারণ করে আবারও রাষ্ট্র রাজনীতিকে কলঙ্কিত করার রাজনীতি জারি রেখেছে। সেটিই বাংলাদেশের জন্য দুর্ভাগ্যের এবং অনিশ্চয়তার অবস্থান ধরে রেখেছে। রাষ্ট্র ও সমাজকে এই সামগ্রিক বিষয়টিকে উপলব্ধিতে এনে কাজ করতে হবে। মানুষকে ন্যায়বিচারের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে হবে। তবেই বাংলাদেশে হবে স্থায়ীভাবে কলঙ্কের অপধারামুক্ত একটি মানবতাবাদী আধুনিক রাষ্ট্র।
লেখক: অধ্যাপক, গবেষক।